শার্শায় অবৈধ ইট ভাটা আর বালু উত্তোলনে হুমকির মুখে পরিবেশ, নীরব প্রশাসন
যশোর প্রতিনিধি: যশোরের শার্শায় অবাধে একের পর এক চলছে অবৈধ ইট ভাটা নির্মাণ। পাশাপাশি অবাধে বালু উত্তোলনে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশের ভারসাম্য। অবৈধ মাটি ও ইটবাহী যানবাহনের চাপায় প্রতিনিয়ত জীবন ঝরেছে মানুষের। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।ভুক্তভোগী শার্শা উপজেলার বাসিন্দা ঢাকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান নিপুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, অবৈধ ইটভাটাগুলো একটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় কিনা একটু দেখেন। পিচের পাকা রাস্তা। অথচ, অল্প বৃষ্টি হলে রাস্তার বেহাল অবস্থা হয়ে যায়। ইট ভাটার গাড়ি থেকে পড়া কাদা মাটি পরিষ্কার করে রাস্তাগুলো একটু চলাচলের উপযোগী রাখার ব্যবস্থা করুন। প্রভাষক মনির হোসেন বলেন, কৃষি জমির পাশে ইট ভাটা থাকলে ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় ও জীব বৈচিত্র্য ক্ষতির মুখে পড়ে। এছাড়া নিয়ন না মেনে বালু উত্তোলনের কারণে যে কোনো সময় ভূমি ধসের ঘটনাও ঘটতে পারে। এ কারণে ইট ভাটা নির্মাণ বা বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে নিয়ম মানতে হবে।উপজেলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ ডিসেম্বর নয়ন কুমার রাজবংশী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে যোগদান করলেও এখন পর্যন্ত কোনো অবৈধ স্থাপনা, অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি কোনো অভিযান পরিচালনা করেননি। অন্যদিকে অভিযোগ আছে প্রভাবশালীরা উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে দেদারছে বালু, মাটি উত্তোলন, ইট ভাটা, করাতকল, ক্লিনিক পরিচালনা করে আসছে।শার্শা উপজেলাব্যাপী অবাধে চলছে অবৈধ ১৯টি ইটভাটা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯টি ইটভাটার না আছে পরিবেশ ছাড়পত্র, না আছে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন। একাধিক ভাটা আছে সরকারি স্কুলের পাশে ও আবাসিক এলাকায়। গত বছর ১৩ নভেম্বর হাইকোর্ট দেশের সব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে জেলা প্রশাসকদের ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চললেও শার্শা উপজেলার চিত্র ভিন্ন। বেনাপোলের বাসিন্দা ফারুক আহম্মেদ জানান, অনেক বছর যাবৎ বাহাদুরপুর রোড়ে আবাসিক এলাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আলামিন স-মিল। এই স-মিলের বিকট শব্দ ও কাঠের গুড়ার কারণে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। একাধিকবার পৌরমেয়রসহ উপজেলা প্রশাসনের নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি।ভুক্তভোগী শার্শার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন জানান, সজনের ঘেরের পাশে ফসলি জমি থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বাড়ির পাশ দিয়ে দিনে ও রাতে দেদারছে বালুবাহী ট্রাক্টর-ট্রলি চলাচলের ফলে ধুলাবালির কারণে অতিষ্ঠ গ্রামবাসী। বাহাদুরপুর ইউনিয়নের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থান বাহাদুরপুর বাওর থেকে জনসম্মুখে মেইন রডের সাথে ব্রিজের পাশে বালু উত্তোলন করে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই।এছাড়াও শার্শা উপজেলার গোগা ইউনিয়ন, কায়বা ইউনিয়ন, পুটখালী ইউনিয়ন, বাঁগআচড়া ইউনিয়ন, লক্ষণপুর ইউনিয়ন, শার্শা ইউনিয়ন, উলশী ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্থানে অবাধে মাটি এবং বালু উত্তোলন করার একাধিক অভিযোগ থাকলেও নেই কোনো প্রতিকার।এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নয়ন কুমার রাজবংশী বলেন, আমিও এমন কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি এবং কয়েকটি ইটভাটার সাথে কথা বলেছি, তারা জানিয়েছেন বর্তমানে লাইসেন্স বন্ধ থাকায় তারা লাইসেন্স করতে পারছেন না। আর মাটি এবং বালুর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেটা সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে জানাবেন। এগুলো দেখার জন্য তিনি আছেন।উল্লেখ্য, গত ৫ বছরে মাটি ও বালুবাহী অবৈধ যানবাহনের চাপায় ১০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে শার্শায়। যাদের অধিকাংশই শিশু। এছাড়াও দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকেই। ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি শার্শার পাচভুলোট গ্রামের আবু বক্কর ছিদ্দিকের ছেলে মিজানুর রহমান নিহত হয়। গত বছরের ১৩ সেপ্টম্বর শার্শার উলাশী গ্রামের মনিরের ছেলে আব্দুর রহমান মাটির ট্রলির চাপায় নিহত হয়। ২০২১ সালের ২২ মে শার্শার সেতাই গ্রামে মাটি বোঝাই ট্রাক্টরের চাপায় হাসান আলীর ছেলে বিপ্লব হোসেন নামের এক যুবক নিহত হয়। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শার্শার কন্যাদহ গ্রামের কোরবান আলীর ৪ বছরের শিশু সন্তান তামিম ইকবাল বালুবোঝাই ট্রাকের চাপায় নিহত হয়। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শার্শার রামপুর গ্রামের শরিফুল ইসলামের শিশু সন্তান মাটিবাহী ট্রাকটরের ধাক্কায় নিহত হয়। ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর শার্শার বসতপুর গ্রামের জতিন দাসের ৭ বছরের শিশু সন্তান সোহাগ দাস মাটিবাহী ট্রাকের চাপায় নিহত হয়। এসময় এলাকার ক্ষুব্ধ জনতা ট্রাকটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়।