ঢাবি অধিভুক্ত ৭ কলেজে অসন্তোষ: ৭ বছরেও মেলেনি সমস্যার সমাধান
বিশেষ প্রতিবেদন: সেশনজট ও অব্যবস্থাপনা দূর করে উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানী ঢাকার ৭টি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। শুরু থেকেই এ নিয়ে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দেয় অসন্তোষ। নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বার বার আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। অসন্তোষ চরমে পৌঁছালে ২০১৮ সালে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে ঢাবি অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়েছিল শাহবাগ চত্বর। ওই সময়ে অধিভুক্তি বাতিলের একই দাবিতে সক্রিয় আন্দোলনে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। তাদের দাবি ছিলো- ৭ কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করায় তাদের বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামো ও প্রশাসনে চাপ বাড়বে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শিক্ষার্থীদেরকে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়তে হবে।পরবর্তীতে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবকিছুই ঠিকঠাক চললেও উল্টো অব্যবস্থাপনায় পড়েছে অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা। অধিভুক্তির পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মান উন্নয়নসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বারবার নানা আশার বাণী শোনালেও ৭ বছরে তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলাফল ও ভর্তি প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, সমন্বয়হীনতা, পরীক্ষা গ্রহণে অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের পাহাড় রয়েছে ঢাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে।ভর্তি সংক্রান্ত সমস্যা কিছুটা কমলেও একাডেমিক পরীক্ষা ও ফলাফল ব্যবস্থাপনায় রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কর্তৃপক্ষের এমন অব্যবস্থাপনার ফলে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। এ সংক্রান্ত শিক্ষার্থীদের দাবি ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধান ও বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করে অব্যবস্থাপনা দূর করতে একটি সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কার্যত তারা কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারেনি। কমিটির পদ আকরে বিভিন্ন মিটিং এবং সভা ব্যতিত এ কমিটির কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির বিষয়ে কয়েক দফায় প্রশাসনকে তাগিদ দেয়া হলেও ৭ বছরেও টনক নড়েনি সমন্বয়ক কমিটি ও ঢাবি প্রশাসনের। শিক্ষার্থীদের ৭ দাবি: ১) পরীক্ষা সমাপ্তের ৩ মাসের মধ্যে সকল বিভাগের ফলাফল প্রকাশ করতে হবে, ২) লিখিত পরীক্ষা সমাপ্তের ৩০ দিনের মধ্যে ব্যবহারিক এবং মৌখিক পরীক্ষা শেষ করতে হবে, ৩) পুনঃ নীরিক্ষার ফলাফল আবেদন করার ১ মাসের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে, ৪) কার্যকর একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে হবে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরীক্ষা আয়োজন ও ফলাফল প্রকাশ করতে হবে, ৫) ফলাফল সমন্বয়ে জটিলতা নিরসন করতে হবে, ৬) সংশ্লিষ্ঠ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিটি কলেজে একটি করে আলাদা মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে এবং ৭) ঢাবি কর্তৃক সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনায় করতে হবে।শিক্ষার্থীদের ৭ দফা দাবির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস দেয়া হলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।করোনার পরবর্তী সেশনজট দূর করতে ঢাবি তাদের নিজস্ব একাডেমিক শিক্ষার্থীদের ৬ মাসের সেমিস্টার ৪ মাসে শেষ করার উদ্যোগ নিলেও অধিভুক্ত কলেজের ক্ষেত্রে এমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ৮ মাসে একেকটি বর্ষ শেষ করার কথা থাকলেও প্রতি সেশনে পরীক্ষা, প্রাকটিক্যাল, ভাইভা শেষ করে ফলাফল প্রকাশে মোট সময় লেগেছে ১৭-১৮ মাস। বিশেষ করে বিজ্ঞান অনুষদের প্রায় সব বিভাগের লিখিত পরীক্ষা শেষে ব্যবহারিক পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ করতে ২-৩ মাস বিলম্ব হচ্ছে। ৩ মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের কথা থাকলেও অনেক বিভাগে ১ বছরেও প্রকাশ করেনি ফলাফল। অন্যদিকে, ঢাবির নিজস্ব কারিকুলামে একদিনেই ১২-১৩ টি বিভাগের ফল একসাথে প্রকাশের নজির দেখা গেছে। ৭-৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও অধিভুক্ত কলেজের অনার্স ১৯-২০ সেশনের ৭ বিভাগ ও ১৮-১৯ সেশনের ২ বিভাগের ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও প্রকাশ হয়নি ডিগ্রি ১৬-১৭ সেশনের ফলাফল। অনার্স ২০-২১ বর্ষের পরীক্ষার ৪ মাস অতিবাহিত হলেও ফলাফল প্রকাশ এখনও শুরু হয়নি। একইভাবে ফলাফল বিলম্বের ভুক্তভোগী হয়েছে মাস্টার্স প্রিলি ২০১৭, মাস্টার্স ফাইনাল ২০১৮ , অনার্স ১৭-১৮ সহ সকল সেশনের শিক্ষার্থীরা। এদিকে প্রতিটি বিভাগের ফলাফল প্রকাশের আগেই ঢাবি কর্তৃপক্ষ ফরম পূরণের নোটিশ প্রকাশ করেছে মাস্টার্স ২০২১ বর্ষের।২০১৪ সালের আগস্টে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দলের পরিদর্শনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সরকারি কলেজগুলোকে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মূলত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমিয়ে উচ্চশিক্ষার মানবৃদ্ধির লক্ষে সরকারি কলেজগুলোতে সেশনজট ও অব্যবস্থাপনা দূর করার লক্ষে এ নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তিতে এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষে একই বছর ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক যৌথ সভায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ স্থানীয় সরকারি কলেজগুলোকে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন।পরে ২০১৭ সালে রাজধানীর ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কিন্তু নানা বিষয়ে ঢাবি প্রশাসন ও সমন্বয়ক কর্তৃপক্ষের এমন গাফিলতির কারণে অধিভুক্ত কলেজগুলোর মান উন্নয়নের পরিবর্তে আরও সমস্যা বেড়েছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৭-১৮ সেশনের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব কি শুধু সেশন ফি আর পরীক্ষার ফি আদায় করা? সবকিছুর সমন্বয় করা কি তাদের দায়িত্ব না? সময়মত পরিক্ষা নেয়া ও ফল প্রকাশ করা কি দায়িত্ব না?অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি করেছেন দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান হোক এবং প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ক্লাস, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ করা হোক।