গাজী মনসুর: মাত্র কদিন আগেই বিএনপি কর্মীরা যেন নিরাপদে কর্মসূচি পালন করতে পারে, সেই তদবির নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সর্বকালের সব কূটনেতিক শিষ্টাচার ভাঙার এই রেকর্ডে বিস্মিত হয়েছিল মানুষ। পিটার হাসের মুখে তখন রাজনৈতিক অধিকার তথা মানবাধিকার রক্ষার বাণী। এরও কদিন আগে থেকে ছিলো স্যাংশনের জুজু বুড়ির গল্প। সেখানেও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে মানবাধিকার রক্ষার ইস্যুটি সামনে ছিল। সব মিলিয়ে গত দু’মাস ধরে মানবাধিকারে ওপর ভর করে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফলাফল ২৮ অক্টোবরের কাকরাইল।এখন কেউ যদি বলেন ২৮ শে অক্টোবরে মানবাধিকার ভাঙার সুযোগ করে দিতেই এত কিছু করেছিলেন হাস সাহেব। তিনি কী ভুল বলবেন? নিশ্চয়ই নয়। কারণ প্রকাশ্যেই আমরা হাসের যত পক্ষপাতদুষ্টের নমুনা দেখেছি, এরকম তাণ্ডব করার সাহস পাওয়ার জন্যে এটা যথেষ্ট। আমার তো মনে হয় সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তদবির নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি শুধু তদবিরের জন্যে ছিল না। বিএনপির যে কর্মীরা ঢাকায় আসছে এটা তদের জন্যে ছিল হাসের পরিস্কার বার্তা। সেটা অনেকটা এরকম ‘তোমরা আসো, যা ইচ্ছে করো। আমি হাস তোমাদের পেছনে আছি।’ বার্তা পেয়ে একান্ত বাধ্য অনুগত বিএনপি কর্মীরা সেই কাজটি করেছে। ২৭শে অক্টোবর রাত থেকে নয়াপল্টনে জমায়েত হওয়া। তার সারাদিন অফিসের সামনে সমাবেশ করা। শেষ হওয়ার একটু আগে সহিংস হয়ে ওঠা। এই তো। পিটার হাস যাদের দায়িত্ব নিয়ে মানবাধিকার রক্ষার সমাবেশের তদবির করেছিরেন তারা মানুষ পুড়িয়ে মারলো। পুলিশ টিপটিয়ে হত্যা করলো। হাসপাতালে আগুন দিল। বেছে বেছে সাংবাদিক ধরে পেটালো। রাতে হাস সাহেব ও তার দেশে একখানা নিন্দা জানিয়ে শেষ করলেন তাদের নিখুঁত পরিবেশনা।আপাতত মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব পিটার হাস ও মার্কিন দূতাবাস এই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু নিয়ে আর কোন টুঁ শব্দ করছেন না। এখন এই মানবাধিকার হরণকারীদের কে দমন করতে যাবে? কে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনে পড়ার ঝুকিঁ নেবে? আমরা আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে ভুল করি। আজ যে বিএনপি নেতা কর্মীরা হাসের কথায় মাঠে নেমেছেন তারাও ভুল করেছেন। কারণ তাদের এই পদক্ষেপের পেছনে গল্পটি মানবাধিকার নয়, আধিপত্য বিস্তারের। অথচ মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র রয়েছে রীতিমতো। ঘোষণাপত্রের প্রথম ধারায় আছে, প্রত্যেক মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার আছে। দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে, সকল ব্যক্তি আইনের সামনে সমান। এই ঘোষণাপত্রে মোট ১৮টি ধারা আছে। জাতি, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের অধিকার ও কর্তব্য এই ঘোষণাপত্রে প্রতিষ্ঠিত । সেই হিসাবে গতকাল যে পুলিশ সদস্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরও তো এই অধিকার আছে। তাহলে তাঁর ব্যাপারে কেন এই নীরবতা?অথচ বাংলাদেশে আমরা দেখলাম মানবাধিকারের প্রশ্নে পিটার হাস একচোখা। কারণ মুখে মুখে মানবাধিকার রক্ষার দায়ভার অনেকদিন ধরেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্ত কাজের বেলায় এসে আমরা দেখলাম ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতা। অথচ শাপলা চত্বরে নিহতদের ভুয়া সংখ্যা প্রকাশ করার অভিযোগে আইনি প্রক্রিয়া মেনে বিচার শুরু হয় মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের।এসময় যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্ন তোলে, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া পরিচালনা হলে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে শঙ্কা কাজ করবে কিনা?এই ইস্যুতে তাদের তৎপরতায় বিশ্বে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন বিষয়টা এমন হয়ে উঠেছিল যে, অপরাধীর গায়ো মানবাধিকার কর্মীর তকমা থাকলে তাকে বিচারের আওতায় আনা যাবে না। আমরা যদি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আসি, সেখানেও দেখবো একই চিত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মানবাধিকার নিয়েও চিন্তিত ছিল। অথচ যুদ্ধের সময় যখন ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলেন, দুই লাখ নারী বীরাঙ্গনা হলেন, শরণার্থী হলেন আরও এক কোটি, তখন তাদের মানবাধিকারের কথা মনে হয়নি; যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলো। এবছরের শুরুতে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন-২০২২ এ জামায়াতে ইসলামীর মানবাধিকার নিয়ে সচেতন দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রকে। অথচ, দলটির গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের নীতিগুলির পরিপন্থী হওয়ায় ২০১৩ সালে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। ২০১৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর বিধান অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে। যে রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে; যুদ্ধাপরাধ ও চরমপন্থায় জড়িত ছিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, লিঙ্গ সমতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে, সেই দলটি নিজেদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ত্রাণকর্তা দাবি করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তার কারণ।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাচলের কোনো স্বাধীনতা নেই এবং সরকার বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্মনিবন্ধন বা নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। অথচ, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী বলে না। তাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে। তাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চলাফেরার স্বাধীনতা, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করা বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়। কিন্তু এই বাস্তুচ্যুতদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্মা আইন প্রণয়ন ছাড়া আর কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে?এখন বলতে বাধা নেই, উদ্দেশ্যের বাইরে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হলে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা না। পাঠক দেখুন, বিএনপির নেতাকর্মীরা শনিবার পিটিয়ে যে পুলিশ সদস্যকে হত্যা করলো, তাঁর মানবাধিকারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র বা পিটার হাস প্রায় নীরব। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে পিটার হাস অনেক মন্তব্য করেছেন এতদিন। অথচ ২৮ অক্টোবর স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা যখন হামলার শিকার হলেন, সেই ব্যাপারেও মার্কিন দূতাবাস কোনো জোরালে মন্তব্য করছে না।এখন তো বলতে বাধ্য হতে হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সচতনতা পক্ষপাতদুষ্ট। তাদের এই মানবাধিকার রক্ষার যে উদ্বেগ, সেটার পেছনে সব সময় অন্য উদ্দেশ্য থাকে। তাই মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে নিজেদের স্বার্থের উপর। তারা চায় তাবেদার সরকার, তারা চায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। আর এটা যখন দরকার তখনই কেবল তাদের মানবাধিকার বোধ জাগ্রত হয়।লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
৩০ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৫২ এএম
ড. ফরিদুল আলম: নিজ ঘর না সামলে আজকাল পশ্চিমার যেভাবে আমাদের রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা এবং মানবাধিকার ইস্যুতে একের পর এক হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে এর নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের নিজ দেশের কিছু মানুষ এবং সুবিধাভোগী চক্র বিদেশি শক্তিগুলোকে এ ধরণের সুযোগ করে দিচ্ছেন। আজ কথা বলছি তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর অন্যতম কর্তাব্যক্তি আদিলুর রহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একটি বিচারিক আদালত কর্তৃক শাস্তি এবং এ বিষয় নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)-র পার্লামেন্টে পাশকৃত প্রস্তাব, যেখানে তারা আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন খোদ ইইউ পার্লামেন্ট সদস্য ম্যাক্সিমিলিয়ন ক্রাহ। সুযোগ পেলেই পশ্চিমারা আমাদের মাননাধিকার শেখাতে আসে এবং এটিকে আমাদের সাহায্যের বিনিময়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।তাদের এই তথাকথিত মানবাধিকার চর্চার বিষয়টি কতটুকু স্ববিরোধী এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহারণ হচ্ছে ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যকার চলমান সংঘাতে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী (সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে) কর্তৃক গাজা উপত্যকায় জাতিগত ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত বিষয়ে কোন কথা ইইউ-র কাছ থেকে এখন পর্যন্ত শুনিনি। প্রকারান্তরে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের গতিবিধি দিয়েই কিন্তু তাদের মানসিকতাকে যাচাই করতে পারছি। সেই সাথে দশকের পর দশক ধরে চলমান ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতে পশ্চিমারা সরাসরি ইসরাইলের পক্ষ্যেই তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে আসছে।বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক সাধিত তাণ্ডবে সরকারের তরফ থেকে যে ভূমিকা নেয়া হয়েছে, এক্ষেত্রে সরকার ভুলটি কোথায় করেছে, সেই প্রশ্নে না গিয়ে গুজব সৃষ্টিকারী কিছু ব্যক্তির পক্ষ্যে সরাসরি অবস্থান নিয়ে তারা আসলে আমাদের দেশকে নিয়ে কি ভাবছে এবং কোন পর্যায়ে টেনে নামাতে চাইছে- বিষয়টি কিন্তু গভীর উদ্বেগের। আমরা যদি পাল্টা আমাদের দিক থেকে তাদের উল্টো জিজ্ঞেস করি, পশ্চিমা কোন দেশের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে যদি কোন অপশক্তি সাধারণ জনগণের অধিকারের বিপরীতে কাজ করে তাহলে সেদেশ বা দেশগুলোর সরকার কি করে থাকে? আমরা এরকম অনেক দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্যসহ অনেক ইউরোপীয় দেশে তাদের ভাষায় বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী হামলার বিপরীতে বন্দুক যুদ্ধের মাধ্যমে কখনও হামলাকারীদের পাকরাও আবার কখনও হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়। কিছুদিন আগেও ফ্রান্সে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যা নিয়ে ব্যাপক বিদ্রোহ হয়েছে। দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু মুসলিম এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের জবাবে কি আমরা কখনো ইইউর মানবাধিকার কমিশনকে সচেতনভাবে কোন ভূমিকা নিতে দেখেছি? দেখিনি। বাংলাদেশের বিচারিক আদালতের রায়ে যিনি দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদন্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তার অপরাধের মাত্রাটুকু যদি আমরা বিবেচনা করে দেখি তাহলেই বুঝতে পারব পশ্চিমা ইইউ কর্তৃক এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া কতটা অশোভন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের সময় তারা যে ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, এতে করে পুরো ঢাকা প্রায় অচল হবার অবস্থা হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে বারবার তাদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে সভা সমাবেশ এবং যৌক্তিক পন্থায় তাদের দাবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জনজীবনে আতংক সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে বলা হলেও তারা সেবিষয়ে কর্ণপাত করেনি। সবশেষে জনস্বার্থে পুলিশী অভিযানের মধ্য দিয়ে ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেলেও অধিকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় ব্যাপক অভিযানে ৬৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে দেখা যায়, তাদের দাবি করা অনেকেই স্ব স্ব কর্মস্থলে চাকরি করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের তালিকা চেয়ে অধিকারকে চিঠি দেয়া হলে সেই চিঠিকে গ্রাহ্য করেনি তারা। এর মধ্য দিয়ে এটাই মনে হওয়া প্রাসঙ্গিক যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে উস্কানী দেয়ার মাধ্যমে দেশে এবং দেশের অভ্যন্তরে তারা সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছে। এর পদক্ষেপ হিসেবে মামলা এবং ১০ বছরের বেশি সময় পর রায় হলে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান এবং পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তারা যদি তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করে তাদের দাবি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা প্রমাণ করতে পারতেন তাহলে তো আর মামলার কোন আবশ্যকতা থাকতনা। নিছক গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেশের কোটি কোটি মানুষকে নিয়ে তারা ছেলেখেলায় মেতে উঠেছিলেন। এর পেছনে দেশীয় অপশক্তির মদদের সাথে বিদেশী শক্তির উস্কানী সমন্বিতভাবে কাজ করেছে, যার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর এটা করতে পারলে এখানে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মত করে তারা তাদের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে পারবে। যে বিষয়টি তাদের নিজের দেশের ক্ষেত্রেও অমার্জনীয় অপরাধের পর্যায়ে পরে, সেখানে আমাদের আদালতের রায়কে নিয়ে কটাক্ষ করা এবং বাতিলের দাবী করা এবং এটিকে মানবাধিকার পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করার চেষ্টা বৈ অন্য কিছু নয়।ইইউ-র সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের রাজনীতিতে তারাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে হস্তক্ষেপ করতে চাওয়ার প্রয়াস একই সূত্রে গাঁথা। একটি দেশের আদালতের রায় নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে তারা কোন ধরণের মানবাধিকারের চর্চা করতে চেয়েছেন সেটা এক বড় প্রশ্ন। তথাকথিত কিছু মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের ১৭ কোটির অধিক মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং চর্চায় কাজ করছে নাকি এর নাম নিয়ে কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে বিদেশীদের কাছে ধর্না দিচ্ছে বিষয়টি আজ সচেতন মহলের জন্য ভাবনার বিষয়। লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৫০ এএম
ড. ফরিদুল আলম: নিজ ঘর না সামলে আজকাল পশ্চিমার যেভাবে আমাদের রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা এবং মানবাধিকার ইস্যুতে একের পর এক হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে এর নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের নিজ দেশের কিছু মানুষ এবং সুবিধাভোগী চক্র বিদেশি শক্তিগুলোকে এ ধরণের সুযোগ করে দিচ্ছেন। আজ কথা বলছি তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর অন্যতম কর্তাব্যক্তি আদিলুর রহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের একটি বিচারিক আদালত কর্তৃক শাস্তি এবং এ বিষয় নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)-র পার্লামেন্টে পাশকৃত প্রস্তাব, যেখানে তারা আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন খোদ ইইউ পার্লামেন্ট সদস্য ম্যাক্সিমিলিয়ন ক্রাহ। সুযোগ পেলেই পশ্চিমারা আমাদের মাননাধিকার শেখাতে আসে এবং এটিকে আমাদের সাহায্যের বিনিময়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।তাদের এই তথাকথিত মানবাধিকার চর্চার বিষয়টি কতটুকু স্ববিরোধী এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহারণ হচ্ছে ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যকার চলমান সংঘাতে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী (সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে) কর্তৃক গাজা উপত্যকায় জাতিগত ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত বিষয়ে কোন কথা ইইউ-র কাছ থেকে এখন পর্যন্ত শুনিনি। প্রকারান্তরে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের গতিবিধি দিয়েই কিন্তু তাদের মানসিকতাকে যাচাই করতে পারছি। সেই সাথে দশকের পর দশক ধরে চলমান ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতে পশ্চিমারা সরাসরি ইসরাইলের পক্ষ্যেই তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে আসছে।বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক সাধিত তাণ্ডবে সরকারের তরফ থেকে যে ভূমিকা নেয়া হয়েছে, এক্ষেত্রে সরকার ভুলটি কোথায় করেছে, সেই প্রশ্নে না গিয়ে গুজব সৃষ্টিকারী কিছু ব্যক্তির পক্ষ্যে সরাসরি অবস্থান নিয়ে তারা আসলে আমাদের দেশকে নিয়ে কি ভাবছে এবং কোন পর্যায়ে টেনে নামাতে চাইছে- বিষয়টি কিন্তু গভীর উদ্বেগের। আমরা যদি পাল্টা আমাদের দিক থেকে তাদের উল্টো জিজ্ঞেস করি, পশ্চিমা কোন দেশের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে যদি কোন অপশক্তি সাধারণ জনগণের অধিকারের বিপরীতে কাজ করে তাহলে সেদেশ বা দেশগুলোর সরকার কি করে থাকে? আমরা এরকম অনেক দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্যসহ অনেক ইউরোপীয় দেশে তাদের ভাষায় বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী হামলার বিপরীতে বন্দুক যুদ্ধের মাধ্যমে কখনও হামলাকারীদের পাকরাও আবার কখনও হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়। কিছুদিন আগেও ফ্রান্সে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হত্যা নিয়ে ব্যাপক বিদ্রোহ হয়েছে। দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘু মুসলিম এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের জবাবে কি আমরা কখনো ইইউর মানবাধিকার কমিশনকে সচেতনভাবে কোন ভূমিকা নিতে দেখেছি? দেখিনি। বাংলাদেশের বিচারিক আদালতের রায়ে যিনি দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদন্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তার অপরাধের মাত্রাটুকু যদি আমরা বিবেচনা করে দেখি তাহলেই বুঝতে পারব পশ্চিমা ইইউ কর্তৃক এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া কতটা অশোভন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের সময় তারা যে ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, এতে করে পুরো ঢাকা প্রায় অচল হবার অবস্থা হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে বারবার তাদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে সভা সমাবেশ এবং যৌক্তিক পন্থায় তাদের দাবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জনজীবনে আতংক সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে বলা হলেও তারা সেবিষয়ে কর্ণপাত করেনি। সবশেষে জনস্বার্থে পুলিশী অভিযানের মধ্য দিয়ে ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেলেও অধিকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় ব্যাপক অভিযানে ৬৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে দেখা যায়, তাদের দাবি করা অনেকেই স্ব স্ব কর্মস্থলে চাকরি করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের তালিকা চেয়ে অধিকারকে চিঠি দেয়া হলে সেই চিঠিকে গ্রাহ্য করেনি তারা। এর মধ্য দিয়ে এটাই মনে হওয়া প্রাসঙ্গিক যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে উস্কানী দেয়ার মাধ্যমে দেশে এবং দেশের অভ্যন্তরে তারা সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছে। এর পদক্ষেপ হিসেবে মামলা এবং ১০ বছরের বেশি সময় পর রায় হলে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান এবং পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানকে ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তারা যদি তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করে তাদের দাবি অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা প্রমাণ করতে পারতেন তাহলে তো আর মামলার কোন আবশ্যকতা থাকতনা। নিছক গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেশের কোটি কোটি মানুষকে নিয়ে তারা ছেলেখেলায় মেতে উঠেছিলেন। এর পেছনে দেশীয় অপশক্তির মদদের সাথে বিদেশী শক্তির উস্কানী সমন্বিতভাবে কাজ করেছে, যার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর এটা করতে পারলে এখানে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মত করে তারা তাদের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে পারবে। যে বিষয়টি তাদের নিজের দেশের ক্ষেত্রেও অমার্জনীয় অপরাধের পর্যায়ে পরে, সেখানে আমাদের আদালতের রায়কে নিয়ে কটাক্ষ করা এবং বাতিলের দাবী করা এবং এটিকে মানবাধিকার পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করার চেষ্টা বৈ অন্য কিছু নয়।ইইউ-র সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের রাজনীতিতে তারাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে হস্তক্ষেপ করতে চাওয়ার প্রয়াস একই সূত্রে গাঁথা। একটি দেশের আদালতের রায় নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে তারা কোন ধরণের মানবাধিকারের চর্চা করতে চেয়েছেন সেটা এক বড় প্রশ্ন। তথাকথিত কিছু মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের ১৭ কোটির অধিক মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং চর্চায় কাজ করছে নাকি এর নাম নিয়ে কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে বিদেশীদের কাছে ধর্না দিচ্ছে বিষয়টি আজ সচেতন মহলের জন্য ভাবনার বিষয়। লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৫০ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে মানবাধিকারের ইস্যু তুলে বারবার সরকারকে কাঠগোড়ায় তোলার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছুই বলেনা আমেরিকা। ইসরায়েলের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রাণ গেছে শিশু-নারীদের। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিশ্চুপ ওয়াশিংটন।সমুদ্র উপকূলীয় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজাকে দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েল অবরুদ্ধ করে রেখেছে। প্রায় বিচ্ছিন্ন এই ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে সশস্ত্র গ্রুপ হামাস। হামাসের রকেট হামলার জবাবে প্রায়ই ইসরায়েলি বাহিনী স্থল ও আকাশপথে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করা হামাস গ্রুপ শনিবার ভোর থেকে স্থল, জল ও আকাশপথে সমন্বিত হামলা করে ইসরায়েলে। এদিকে হামাসের হামলার পর গাজায় পাল্টা বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।ইসরায়েলে এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। হামাসের এ হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়ে প্রতিরক্ষা সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জাতীয় জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণের সঙ্গে আছি। এই হামলায় ইসরায়েলিদের প্রাণ হারানোর জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি।’ হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জাচি হানেগবির সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জেক সুলিভান।শনিবার বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ফোন কল করে বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণকে সব ধরনের সমর্থন দিতে প্রস্তুত আছি।’ পরে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস কখনই ন্যায়সংগত হতে পারেন না। ইসরায়েলের নিজেকে এবং তার জনগণকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে।’ এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কি না সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।১৯৬৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মার্কিনীরা ইসরায়েলের পক্ষ নেয়। এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি রচনা করে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কূটনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ইসরায়েল তাদের কার্যকরী এক অস্ত্র হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। এই যুদ্ধে মার্কিনরা বেশ সফলতাও অর্জন করে এবং নিজেদের বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এমন একটি মিত্র দরকার, যারা তাদের প্রতিরূপ হিসেবে কাজ করবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক দূরত্বের একটি বিষয় ছিল। সেই সমস্যা নিরসনে শক্ত ঘাঁটি বিনির্মাণের জন্যই তারা বেছে নেয় ইসরায়েলকে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য তাদের হয়ে ফিলিস্তিনের সাথে দেনদরবার করার দায়িত্ব গ্রহণ করে।একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসের কারণেই এখনো ইসরায়েল যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়। বিগত তিন মার্কিন প্রেসিডেন্টই চেষ্টা করেছেন ফিলিস্তিনের সাথে ইসরায়েলের একটি সুরাহা করার। তবে এক্ষেত্রে তাদের সমর্থনের পাল্লা তেল আবিবের দিকেই বেশি থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই ইসরায়েলের অনেক অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে, যা অব্যাহত রয়েছে বর্তমানেও। কিন্তু এর পেছনের রহস্য কী? শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য তারা ইসরায়েলকে সমর্থন করে, নাকি আরো কোনো কারণ রয়েছে?যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ককে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্কও বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব সৃষ্টির জন্য ইসরায়েল যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে এরপরও দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখান থেকে লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।১৯৮৫ সালে ইসরায়েলের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের হার অনেক বেড়েছে। ইসরায়েলে থাকা মার্কিন দূতাবাসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দুই দেশ প্রায় ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছে, যা থেকে সিংহভাগ লাভবান হয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ইসরায়েল।যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরায়েল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। দেশটির বিভিন্ন রাজ্য ইহুদিপ্রধান দেশটির সাথে বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে, যা থেকে সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে। বলা হয়ে থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে তার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছে। এর প্রতিদান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও কম দিচ্ছে না!এছাড়াও আরো গভীরে গেলে দেখা যায় যে , আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলতঃ কর্পোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে। এসব কর্পোরেট হাউজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এদের মালিক কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা চীফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার, সিইও হলেন ইহুদি কমিউনিটির মানুষ।২০২০ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন (৩৮০ কোটি) ডলার সাহায্য দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে ইসরায়েলকে দীর্ঘমেয়াদী যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার অধীনেই এই সাহায্য গেছে। প্রায় পুরোটাই ছিল সামরিক সাহায্য।২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা ইসরায়েলের সাথে এক চুক্তি সই করেন যার অধীনে ২০১৭-১৮ সাল থেকে তার পরবর্তী ১০ বছর ইসরায়েল ৩৮ বিলিয়ন ডলার বা ৩৮০০ কোটি ডলার সামরিক সাহায্য পাবে। তার আগে দশ বছরের তুলনায় ঐ সাহায্য বেড়েছে প্রায় ছয় শতাংশ। এ বাদেও, গত বছর ইসরায়েলে নতুন অভিবাসীদের পুনর্বাসনে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার সাহায্য দিয়েছে। বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে ইহুদিরা ইসরায়েলে গিয়ে বসতি গড়তে চাইলে তাকে স্বাগত জানানোর নীতি বহুদিন ধরে সেদেশে রয়েছে।ইসরায়েলকে অত্যাধুনিক একটি সামরিক শক্তিধর দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে সাহায্য করছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র কেনার জন্য তহবিল যোগানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল আমেরিকা থেকে ৫০টি অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনেছে যা দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো যায়। প্রতিটি বিমানের দাম প্রায় ১০ কোটি ডলার। ইসরায়েল আমেরিকার কাছ থেকে ২৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে আটটি কেসি-৪৬এ বোয়িং ‘পেগাসাস‘ বিমান কিনেছে। এই বিমান থেকে আকাশে এফ-৩৫ বিমানে জ্বালানি তেল ভরা যায়।২০২০ সালে ইসরায়েলকে আমেরিকা যে ৩৮০ কোটি ডলার দিয়েছে, তার মধ্যে ৫০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। এর মধ্যে রয়েছে ‘আয়রন ডোম‘ ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা যা দিয়ে ইসরায়েল রকেট হামলা প্রতিহত করে। ২০১১ সাল থেকে আমেরিকা ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ১৬০ কোটি ডলার দিয়েছে। এ ছাড়াও, গাজায় গোপন সুড়ঙ্গ শনাক্ত করাসহ বেশ কিছু সামরিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তৈরিতে আমেরিকা ইসরায়েলকে তহবিল ছাড়াও বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। ইসরায়েলের সরকার সমরাস্ত্র কেনা এবং সামরিক প্রশিক্ষণে বহু টাকা খরচ করে যার অনেকটাই আসে আমেরিকার দেওয়া সাহায্য থেকে।যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)-এর অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আইপ্যাক কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। কিন্তু এরপর তাদের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের উপর বড় প্রভাব রয়েছে। মার্কিন সরকারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে। কিন্তু তারা এই কাজ করে কীভাবে?'কংগ্রেশনাল ক্লাব' নামে আইপ্যাকের বিশেষ একটি দল আছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি নির্বাচনে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ডলার চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই অর্থ ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। পরবর্তীতের এদের মধ্যে যারা জয়লাভ করে, তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে। তবে আইপ্যাক সামগ্রিকভাবে কত অর্থ ব্যয় করে, সেই সম্পর্কে জানা যায় না। তবে তাদের এমন কিছু সদস্য আছে, যারা এক মিলিয়ন থেকে শত মিলিয়ন পর্যন্ত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। আর এই সকল দাতাদের ধ্যান-ধারণা সবই ইসরায়েলকে ঘিরে। তারা যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে চান।শুধুমাত্র ট্রাম্পের শাসনামলেই আইপ্যাক অনেকগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা এবং ফিলিস্তিনকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করা।আইপ্যাক কতটা শক্তিশালীআইপ্যাক সর্বশেষ ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি বার্ষিক সম্মেলন করে, যেখানে প্রায় ২০ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন এবং শীর্ষস্থানীয় মার্কিন রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত উপস্থিতিও ছিল সেখানে। এমনকি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও উপস্থিত হয়েছিলেন, ছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও।এছাড়া ইসরাইলপন্থি গোষ্ঠীগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রার্থীদের লাখ লাখ ডলার অনুদান দিয়ে থাকে। ২০২০-এর নির্বাচনে ইসরাইলপন্থি গোষ্ঠীগুলোর অনুদান বাবদ খরচ হয়েছিল ৩০.৯৫ মিলিয়ন ডলার-যার ৬৩ শতাংশ পেয়েছিল ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা এবং ৩৬ শতাংশ গেছে রিপাবলিকান প্রার্থীদের হাতে।নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বরাবরের মতো এবারও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে গিয়ে ইসরায়েলের পক্ষ নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো জোট। প্রায়ই শান্তি আলোচনার নাটক মঞ্চস্থ করলেও কখনোই সফলতা আসেনি কারন সর্বদা তারা ইসরায়েলের পক্ষে থেকেছে। তাদের অর্থ, অস্ত্র ও সর্বাত্মক সহায়তায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী জনগণ এর উপর দশকের পর দশক ধরে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে দখলদার ইসরায়েল। এবারের সংঘাতেও তারা ইহুদিদের পক্ষ নিলো। মানবাধিকারের কথা বলে মুখে ফেনা তোলা দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাব, দ্বিচারিতা আর স্বার্থপরতার আরেকটি নজির হয়ে থাকবে এই সমর্থন।
০৮ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪১ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে মানবাধিকারের ইস্যু তুলে বারবার সরকারকে কাঠগোড়ায় তোলার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছুই বলেনা আমেরিকা। ইসরায়েলের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রাণ গেছে শিশু-নারীদের। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিশ্চুপ ওয়াশিংটন।সমুদ্র উপকূলীয় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজাকে দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েল অবরুদ্ধ করে রেখেছে। প্রায় বিচ্ছিন্ন এই ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে সশস্ত্র গ্রুপ হামাস। হামাসের রকেট হামলার জবাবে প্রায়ই ইসরায়েলি বাহিনী স্থল ও আকাশপথে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করা হামাস গ্রুপ শনিবার ভোর থেকে স্থল, জল ও আকাশপথে সমন্বিত হামলা করে ইসরায়েলে। এদিকে হামাসের হামলার পর গাজায় পাল্টা বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।ইসরায়েলে এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। হামাসের এ হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়ে প্রতিরক্ষা সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জাতীয় জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণের সঙ্গে আছি। এই হামলায় ইসরায়েলিদের প্রাণ হারানোর জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি।’ হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জাচি হানেগবির সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জেক সুলিভান।শনিবার বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ফোন কল করে বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণকে সব ধরনের সমর্থন দিতে প্রস্তুত আছি।’ পরে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস কখনই ন্যায়সংগত হতে পারেন না। ইসরায়েলের নিজেকে এবং তার জনগণকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে।’ এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কি না সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।১৯৬৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মার্কিনীরা ইসরায়েলের পক্ষ নেয়। এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি রচনা করে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কূটনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ইসরায়েল তাদের কার্যকরী এক অস্ত্র হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। এই যুদ্ধে মার্কিনরা বেশ সফলতাও অর্জন করে এবং নিজেদের বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এমন একটি মিত্র দরকার, যারা তাদের প্রতিরূপ হিসেবে কাজ করবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক দূরত্বের একটি বিষয় ছিল। সেই সমস্যা নিরসনে শক্ত ঘাঁটি বিনির্মাণের জন্যই তারা বেছে নেয় ইসরায়েলকে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য তাদের হয়ে ফিলিস্তিনের সাথে দেনদরবার করার দায়িত্ব গ্রহণ করে।একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসের কারণেই এখনো ইসরায়েল যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়। বিগত তিন মার্কিন প্রেসিডেন্টই চেষ্টা করেছেন ফিলিস্তিনের সাথে ইসরায়েলের একটি সুরাহা করার। তবে এক্ষেত্রে তাদের সমর্থনের পাল্লা তেল আবিবের দিকেই বেশি থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই ইসরায়েলের অনেক অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে, যা অব্যাহত রয়েছে বর্তমানেও। কিন্তু এর পেছনের রহস্য কী? শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য তারা ইসরায়েলকে সমর্থন করে, নাকি আরো কোনো কারণ রয়েছে?যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ককে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্কও বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব সৃষ্টির জন্য ইসরায়েল যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে এরপরও দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখান থেকে লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।১৯৮৫ সালে ইসরায়েলের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের হার অনেক বেড়েছে। ইসরায়েলে থাকা মার্কিন দূতাবাসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দুই দেশ প্রায় ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছে, যা থেকে সিংহভাগ লাভবান হয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ইসরায়েল।যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরায়েল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। দেশটির বিভিন্ন রাজ্য ইহুদিপ্রধান দেশটির সাথে বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে, যা থেকে সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে। বলা হয়ে থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে তার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছে। এর প্রতিদান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও কম দিচ্ছে না!এছাড়াও আরো গভীরে গেলে দেখা যায় যে , আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলতঃ কর্পোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে। এসব কর্পোরেট হাউজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এদের মালিক কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা চীফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার, সিইও হলেন ইহুদি কমিউনিটির মানুষ।২০২০ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন (৩৮০ কোটি) ডলার সাহায্য দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে ইসরায়েলকে দীর্ঘমেয়াদী যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার অধীনেই এই সাহায্য গেছে। প্রায় পুরোটাই ছিল সামরিক সাহায্য।২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা ইসরায়েলের সাথে এক চুক্তি সই করেন যার অধীনে ২০১৭-১৮ সাল থেকে তার পরবর্তী ১০ বছর ইসরায়েল ৩৮ বিলিয়ন ডলার বা ৩৮০০ কোটি ডলার সামরিক সাহায্য পাবে। তার আগে দশ বছরের তুলনায় ঐ সাহায্য বেড়েছে প্রায় ছয় শতাংশ। এ বাদেও, গত বছর ইসরায়েলে নতুন অভিবাসীদের পুনর্বাসনে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার সাহায্য দিয়েছে। বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে ইহুদিরা ইসরায়েলে গিয়ে বসতি গড়তে চাইলে তাকে স্বাগত জানানোর নীতি বহুদিন ধরে সেদেশে রয়েছে।ইসরায়েলকে অত্যাধুনিক একটি সামরিক শক্তিধর দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে সাহায্য করছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র কেনার জন্য তহবিল যোগানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল আমেরিকা থেকে ৫০টি অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনেছে যা দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো যায়। প্রতিটি বিমানের দাম প্রায় ১০ কোটি ডলার। ইসরায়েল আমেরিকার কাছ থেকে ২৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে আটটি কেসি-৪৬এ বোয়িং ‘পেগাসাস‘ বিমান কিনেছে। এই বিমান থেকে আকাশে এফ-৩৫ বিমানে জ্বালানি তেল ভরা যায়।২০২০ সালে ইসরায়েলকে আমেরিকা যে ৩৮০ কোটি ডলার দিয়েছে, তার মধ্যে ৫০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। এর মধ্যে রয়েছে ‘আয়রন ডোম‘ ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা যা দিয়ে ইসরায়েল রকেট হামলা প্রতিহত করে। ২০১১ সাল থেকে আমেরিকা ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ১৬০ কোটি ডলার দিয়েছে। এ ছাড়াও, গাজায় গোপন সুড়ঙ্গ শনাক্ত করাসহ বেশ কিছু সামরিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তৈরিতে আমেরিকা ইসরায়েলকে তহবিল ছাড়াও বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। ইসরায়েলের সরকার সমরাস্ত্র কেনা এবং সামরিক প্রশিক্ষণে বহু টাকা খরচ করে যার অনেকটাই আসে আমেরিকার দেওয়া সাহায্য থেকে।যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)-এর অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আইপ্যাক কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। কিন্তু এরপর তাদের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের উপর বড় প্রভাব রয়েছে। মার্কিন সরকারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে। কিন্তু তারা এই কাজ করে কীভাবে?'কংগ্রেশনাল ক্লাব' নামে আইপ্যাকের বিশেষ একটি দল আছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি নির্বাচনে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ডলার চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই অর্থ ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। পরবর্তীতের এদের মধ্যে যারা জয়লাভ করে, তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে। তবে আইপ্যাক সামগ্রিকভাবে কত অর্থ ব্যয় করে, সেই সম্পর্কে জানা যায় না। তবে তাদের এমন কিছু সদস্য আছে, যারা এক মিলিয়ন থেকে শত মিলিয়ন পর্যন্ত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। আর এই সকল দাতাদের ধ্যান-ধারণা সবই ইসরায়েলকে ঘিরে। তারা যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে চান।শুধুমাত্র ট্রাম্পের শাসনামলেই আইপ্যাক অনেকগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা এবং ফিলিস্তিনকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করা।আইপ্যাক কতটা শক্তিশালীআইপ্যাক সর্বশেষ ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি বার্ষিক সম্মেলন করে, যেখানে প্রায় ২০ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন এবং শীর্ষস্থানীয় মার্কিন রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত উপস্থিতিও ছিল সেখানে। এমনকি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও উপস্থিত হয়েছিলেন, ছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও।এছাড়া ইসরাইলপন্থি গোষ্ঠীগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রার্থীদের লাখ লাখ ডলার অনুদান দিয়ে থাকে। ২০২০-এর নির্বাচনে ইসরাইলপন্থি গোষ্ঠীগুলোর অনুদান বাবদ খরচ হয়েছিল ৩০.৯৫ মিলিয়ন ডলার-যার ৬৩ শতাংশ পেয়েছিল ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা এবং ৩৬ শতাংশ গেছে রিপাবলিকান প্রার্থীদের হাতে।নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বরাবরের মতো এবারও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে গিয়ে ইসরায়েলের পক্ষ নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো জোট। প্রায়ই শান্তি আলোচনার নাটক মঞ্চস্থ করলেও কখনোই সফলতা আসেনি কারন সর্বদা তারা ইসরায়েলের পক্ষে থেকেছে। তাদের অর্থ, অস্ত্র ও সর্বাত্মক সহায়তায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী জনগণ এর উপর দশকের পর দশক ধরে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে দখলদার ইসরায়েল। এবারের সংঘাতেও তারা ইহুদিদের পক্ষ নিলো। মানবাধিকারের কথা বলে মুখে ফেনা তোলা দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাব, দ্বিচারিতা আর স্বার্থপরতার আরেকটি নজির হয়ে থাকবে এই সমর্থন।
০৮ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪১ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে মানবাধিকারের ইস্যু তুলে বারবার সরকারকে কাঠগোড়ায় তোলার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছুই বলেনা আমেরিকা। ইসরায়েলের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ২৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রাণ গেছে শিশু-নারীদের। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিশ্চুপ ওয়াশিংটন।সমুদ্র উপকূলীয় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজাকে দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েল অবরুদ্ধ করে রেখেছে। প্রায় বিচ্ছিন্ন এই ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে সশস্ত্র গ্রুপ হামাস। হামাসের রকেট হামলার জবাবে প্রায়ই ইসরায়েলি বাহিনী স্থল ও আকাশপথে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করা হামাস গ্রুপ শনিবার ভোর থেকে স্থল, জল ও আকাশপথে সমন্বিত হামলা করে ইসরায়েলে। এদিকে হামাসের হামলার পর গাজায় পাল্টা বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।ইসরায়েলে এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। হামাসের এ হামলাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়ে প্রতিরক্ষা সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জাতীয় জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়েন ওয়াটসন বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণের সঙ্গে আছি। এই হামলায় ইসরায়েলিদের প্রাণ হারানোর জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি।’ হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জাচি হানেগবির সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা জেক সুলিভান।শনিবার বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ফোন কল করে বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণকে সব ধরনের সমর্থন দিতে প্রস্তুত আছি।’ পরে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস কখনই ন্যায়সংগত হতে পারেন না। ইসরায়েলের নিজেকে এবং তার জনগণকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে।’ এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কোনো পক্ষ সুবিধা নিতে চায় কি না সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।১৯৬৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক দ্রুতগতিতে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মার্কিনীরা ইসরায়েলের পক্ষ নেয়। এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি রচনা করে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কূটনীতিকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমাতে ইসরায়েল তাদের কার্যকরী এক অস্ত্র হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। এই যুদ্ধে মার্কিনরা বেশ সফলতাও অর্জন করে এবং নিজেদের বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এমন একটি মিত্র দরকার, যারা তাদের প্রতিরূপ হিসেবে কাজ করবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক দূরত্বের একটি বিষয় ছিল। সেই সমস্যা নিরসনে শক্ত ঘাঁটি বিনির্মাণের জন্যই তারা বেছে নেয় ইসরায়েলকে। যুক্তরাষ্ট্র তখন ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য তাদের হয়ে ফিলিস্তিনের সাথে দেনদরবার করার দায়িত্ব গ্রহণ করে।একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসের কারণেই এখনো ইসরায়েল যেকোনো শান্তি আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়। বিগত তিন মার্কিন প্রেসিডেন্টই চেষ্টা করেছেন ফিলিস্তিনের সাথে ইসরায়েলের একটি সুরাহা করার। তবে এক্ষেত্রে তাদের সমর্থনের পাল্লা তেল আবিবের দিকেই বেশি থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই ইসরায়েলের অনেক অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থেকেছে, যা অব্যাহত রয়েছে বর্তমানেও। কিন্তু এর পেছনের রহস্য কী? শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য তারা ইসরায়েলকে সমর্থন করে, নাকি আরো কোনো কারণ রয়েছে?যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ককে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্কও বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাব সৃষ্টির জন্য ইসরায়েল যেমন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে এরপরও দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, যেখান থেকে লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।১৯৮৫ সালে ইসরায়েলের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের হার অনেক বেড়েছে। ইসরায়েলে থাকা মার্কিন দূতাবাসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দুই দেশ প্রায় ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছে, যা থেকে সিংহভাগ লাভবান হয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ইসরায়েল।যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরায়েল বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। দেশটির বিভিন্ন রাজ্য ইহুদিপ্রধান দেশটির সাথে বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে, যা থেকে সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে। বলা হয়ে থেকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে তার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছে। এর প্রতিদান অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও কম দিচ্ছে না!এছাড়াও আরো গভীরে গেলে দেখা যায় যে , আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলতঃ কর্পোরেট হাউজগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে, সরাতে পারে। এসব কর্পোরেট হাউজগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় এদের মালিক কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা চীফ এক্সজিকিউটিভ অফিসার, সিইও হলেন ইহুদি কমিউনিটির মানুষ।২০২০ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন (৩৮০ কোটি) ডলার সাহায্য দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে ইসরায়েলকে দীর্ঘমেয়াদী যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার অধীনেই এই সাহায্য গেছে। প্রায় পুরোটাই ছিল সামরিক সাহায্য।২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা ইসরায়েলের সাথে এক চুক্তি সই করেন যার অধীনে ২০১৭-১৮ সাল থেকে তার পরবর্তী ১০ বছর ইসরায়েল ৩৮ বিলিয়ন ডলার বা ৩৮০০ কোটি ডলার সামরিক সাহায্য পাবে। তার আগে দশ বছরের তুলনায় ঐ সাহায্য বেড়েছে প্রায় ছয় শতাংশ। এ বাদেও, গত বছর ইসরায়েলে নতুন অভিবাসীদের পুনর্বাসনে যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার সাহায্য দিয়েছে। বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে ইহুদিরা ইসরায়েলে গিয়ে বসতি গড়তে চাইলে তাকে স্বাগত জানানোর নীতি বহুদিন ধরে সেদেশে রয়েছে।ইসরায়েলকে অত্যাধুনিক একটি সামরিক শক্তিধর দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে আমেরিকা বছরের পর বছর ধরে সাহায্য করছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র কেনার জন্য তহবিল যোগানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল আমেরিকা থেকে ৫০টি অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনেছে যা দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো যায়। প্রতিটি বিমানের দাম প্রায় ১০ কোটি ডলার। ইসরায়েল আমেরিকার কাছ থেকে ২৪০ কোটি ডলার ব্যয়ে আটটি কেসি-৪৬এ বোয়িং ‘পেগাসাস‘ বিমান কিনেছে। এই বিমান থেকে আকাশে এফ-৩৫ বিমানে জ্বালানি তেল ভরা যায়।২০২০ সালে ইসরায়েলকে আমেরিকা যে ৩৮০ কোটি ডলার দিয়েছে, তার মধ্যে ৫০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। এর মধ্যে রয়েছে ‘আয়রন ডোম‘ ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা যা দিয়ে ইসরায়েল রকেট হামলা প্রতিহত করে। ২০১১ সাল থেকে আমেরিকা ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য ১৬০ কোটি ডলার দিয়েছে। এ ছাড়াও, গাজায় গোপন সুড়ঙ্গ শনাক্ত করাসহ বেশ কিছু সামরিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তৈরিতে আমেরিকা ইসরায়েলকে তহবিল ছাড়াও বিভিন্নভাবে সাহায্য করছে। ইসরায়েলের সরকার সমরাস্ত্র কেনা এবং সামরিক প্রশিক্ষণে বহু টাকা খরচ করে যার অনেকটাই আসে আমেরিকার দেওয়া সাহায্য থেকে।যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পেছনে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (আইপ্যাক)-এর অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আইপ্যাক কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। কিন্তু এরপর তাদের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের উপর বড় প্রভাব রয়েছে। মার্কিন সরকারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে। কিন্তু তারা এই কাজ করে কীভাবে?'কংগ্রেশনাল ক্লাব' নামে আইপ্যাকের বিশেষ একটি দল আছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি নির্বাচনে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ডলার চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই অর্থ ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। পরবর্তীতের এদের মধ্যে যারা জয়লাভ করে, তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে। তবে আইপ্যাক সামগ্রিকভাবে কত অর্থ ব্যয় করে, সেই সম্পর্কে জানা যায় না। তবে তাদের এমন কিছু সদস্য আছে, যারা এক মিলিয়ন থেকে শত মিলিয়ন পর্যন্ত অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। আর এই সকল দাতাদের ধ্যান-ধারণা সবই ইসরায়েলকে ঘিরে। তারা যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে চান।শুধুমাত্র ট্রাম্পের শাসনামলেই আইপ্যাক অনেকগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা এবং ফিলিস্তিনকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করা।আইপ্যাক কতটা শক্তিশালীআইপ্যাক সর্বশেষ ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি বার্ষিক সম্মেলন করে, যেখানে প্রায় ২০ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন এবং শীর্ষস্থানীয় মার্কিন রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত উপস্থিতিও ছিল সেখানে। এমনকি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও উপস্থিত হয়েছিলেন, ছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও।এছাড়া ইসরাইলপন্থি গোষ্ঠীগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রার্থীদের লাখ লাখ ডলার অনুদান দিয়ে থাকে। ২০২০-এর নির্বাচনে ইসরাইলপন্থি গোষ্ঠীগুলোর অনুদান বাবদ খরচ হয়েছিল ৩০.৯৫ মিলিয়ন ডলার-যার ৬৩ শতাংশ পেয়েছিল ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা এবং ৩৬ শতাংশ গেছে রিপাবলিকান প্রার্থীদের হাতে।নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বরাবরের মতো এবারও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে গিয়ে ইসরায়েলের পক্ষ নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো জোট। প্রায়ই শান্তি আলোচনার নাটক মঞ্চস্থ করলেও কখনোই সফলতা আসেনি কারন সর্বদা তারা ইসরায়েলের পক্ষে থেকেছে। তাদের অর্থ, অস্ত্র ও সর্বাত্মক সহায়তায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী জনগণ এর উপর দশকের পর দশক ধরে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে দখলদার ইসরায়েল। এবারের সংঘাতেও তারা ইহুদিদের পক্ষ নিলো। মানবাধিকারের কথা বলে মুখে ফেনা তোলা দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাব, দ্বিচারিতা আর স্বার্থপরতার আরেকটি নজির হয়ে থাকবে এই সমর্থন।
০৮ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪১ পিএম