বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ, সমুদ্রবন্দরগুলোতে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত
নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি আরও শক্তিশালী (ঘনীভূত) হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
২৪ মে শুক্রবার আবহাওয়া অফিসের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল ৬টায় নিম্নচাপটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ- দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এসময় নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৫০কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের গভীর সাগরে না যেতে সতর্ক করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্ট
বাগেরহাট প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব লন্ডভন্ড সুন্দরবনে বন্যপ্রাণির মৃতদেহের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২ জুন রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুন্দরবনের অভ্যন্তরসহ বিভিন্ন নদ-নদী ও চর থেকে ১৩৪টি বন্যপ্রাণির মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বনরক্ষীরা।উদ্ধার করা মৃত এসব বন্যপ্রাণির মধ্যে রয়েছে ১৩০টি হরিণ ও ৪টি বন্য শূকর। সুন্দরবনে একটানা ৩৬ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে চলা এই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা যাওয়া এসব বন্যপ্রাণির উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে বনরক্ষীরা।উদ্ধার করা এসব বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ ম্যানগ্রোভ এই বনের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, সুন্দরবনে ৩৬ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে তাণ্ডব চালায় ঘূণিঝড় রেমাল। এসময় ৬ থেকে ৮ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় সুন্দরবন। দীর্ঘসময় ধরে সুন্দরবনর জলমগ্ন থাকায় বন্যপ্রাণির হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।তিনি আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় শেষ হওয়ার পর গত পাঁচদিনে সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, দুবলা, ডিমেরচর, পক্ষীরচর, শেলারচর, নীলকমল, নারিকেলবাড়িয়া ও জ্ঞানপাড়াসহ বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত ১৩০টি হরিণ ও ৪টি বন্যশূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ১৮টি হরিণ ও একটি অজগর সাপ। আহত প্রাণিদের চিকিৎসা দিয়ে বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
রামপাল (বাগেরহাট) প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় রেমালের ছোবলে বিধ্বস্ত গোটা রামপাল উপজেলা। প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ দুর্গত হয়ে পড়েছে। প্রতি মুহূর্তেই এখনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় ত্রাণ দপ্তরের ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।উপজেলার ত্রাণ দপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মোতাবেক জানা গেছে, এ উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নে প্রায় পৌনে ২ লক্ষ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষকে দুর্গত বলে চিহ্নিত করেছে উপজেলা প্রশাসন।উপজেলা পিআইও মো. মতিউর রহমান জানান, এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মোট ১ হাজার ৪১০টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ৪৫০টি বাড়ি। এতে শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রেমালের ক্ষতি কমাতে ১৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এতে প্রায় ১২ হাজার দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলন। প্রশাসনের নজরদারী থাকায় কোনো মানুষ আহত বা নিহত হননি।উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কার্মকর্তা অসীম কুমার ঘোষ জানান, এ উপজেলায় ৮ হাজার মাছের ঘের ও ১ হাজার ৫শ’ পুকুর ভেসে গেছে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। যা আরও বাড়তে পারে।মৎস্য খামারি মো. রেদওয়ান মারুফ জানান, ‘আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার খামারের সব মাছ ভেসে গেছে। কী করে ব্যাংকের লোন শোধ করবো ভোবে পাচ্ছি না।’ একই কথা বলেন সদরের মৎস্যঘের মালিক শেখ মো. আতাহার আলী। তিনি জানান, ‘৫/৬টি ঘেরের সব মাছ ভেসে গেছে। ধারদেনা করে মাছপোনা ফেলেছি। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার গোলজার হোসেন জানান, রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে থাকায় ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে মাঠে কাজ চলছে।উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্মকর্তা জি, এম অলিউল ইসলাম জানান, ঝড়ে মোট ২ হাজার ৯৩ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আম, কলা, পেঁপে, সবজি ও মরিচের ক্ষতি বেশি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকারও উপরে।মাধ্যমিক শিক্ষা কার্মকর্তা আনোয়ারুল কুদ্দুস জানান, মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সকল এলাকার তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্কুল ও মাদরাসা মিলে মোট ১০ প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২২ লক্ষ টাকা। এছাড়াও অফিস কক্ষে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে চেয়ার টেবিলসহ লক্ষাধিক টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে।উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্মকর্তা মো. মতিউর রহমান জানান, মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেতে বিলম্ব হচ্ছে। মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ লক্ষ টাকার বেশি, যা আরও বাড়বে।পোল্ট্রি ও গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাণী সম্পদ হাসপাতালের প্রতিনিধি সুবাস চন্দ্র জানান, বেশকিছু পোল্ট্রি মালিকের মুরগিসহ ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ চলছে বলে জানান তিনি।রামপাল প্রকল্প উপজেলা বাস্তবায়ন কার্মকর্তা মো. মতিউর রহমান জানান, ১০টি ইউনিয়নে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্যে তথ্য ছক শিট প্রেরণ করা হয়েছে। ৩০ মে বৃহস্পতিবার নাগাদ সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। তবে রেমালের প্রভাবে কেউ মৃত্যুবরণ না করলেও মৎস্যঘের, বাড়িঘর, পোল্ট্রি শিল্পের, অবকাঠামো, স্থাপনা ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার পরিমাণ পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোটি টাকা ধরা হলেও তা হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করছেন ওই কার্মকর্তা।এ বিষয়ে রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা এঁর সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, রেমালের আঘাতে এ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মানুষের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। মৎস্য ঘের ভেসে গেছে, কৃষি, অবকাঠামো, স্থাপনা ও পোল্ট্রি ফার্মের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ৫ টন চাল পেয়েছি। যা আশ্রয় কেন্দ্রের দুর্গতদের দেওয়া হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর বরাদ্দের জন্যে লেখা হচ্ছে। বরাদ্দ পাওয়ার সাথে সাথে তা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে।
মো. কামরুজ্জামান, বাগেরহাট: দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টা সুন্দরবনের উপর তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সুন্দরবন। ২৮ মে মঙ্গলবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৩৯টি হরিণ ও ১টি বন্য শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এছাড়া ১৭টি হরিণকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শুশ্রুষার পর বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।প্রাথমিক অবস্থায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে ৬ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষণ (সিএফ) মিহির কুমার দো এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, সুন্দরবনের কটকা, কচিখালি, দুবলা, বুড়ি গোয়ালিনী, কোকিল মনি, নীলকমল, মান্দারবাড়িয়া ফরেস্ট ক্যাম্পসহ অবকাঠামোগত ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ও সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এটি এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান এ কর্মকর্তা। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নুরুল করিম জানান, দীর্ঘ সময় সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকার জলমগ্ন থাকায় অনেক বন্য প্রাণীর হতহতের ঘটনা ঘটেছে। বন্যপ্রাণীর জন্য খনন করা সুপেয় পানির পুকুরও ভেসে গেছে। বনবিভাগের নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা ওয়ারলেস এখনো সচল হয়নি। তবে বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্টেশনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরা নিরাপদে রয়েছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কাজ চলছে। বন বিভাগের লোকজন সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় কয়েকটি হরিণকে ঝড়ের সময় ভেসে যেতে দেখেছে। দীর্ঘ সময় ঝড়ের প্রভাব থাকায় ভাটার সময়ও জোয়ারের পানি না কমায় সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকা জলমগ্ন ছিল প্রায় ৩০ ঘণ্টা। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে পরবর্তী ঝড় ঝঞ্জা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে এবং বন্যপ্রাণী প্রাণহানির কমাতে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অসংখ্য উঁচু মাটির কেল্লা নির্মাণসহ বাস্তবমুখী অনেক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।দীর্ঘদিন সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী সেফ দা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বাঘ বা হরিণ জাতীয় বন্যপ্রাণী ৬ ঘণ্টার বেশি পানির মধ্যে প্রতিকূল পরিবেশের টিকে থাকতে পারে না। বিগত সময়ে সুন্দরবনের যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে তার স্থায়িত্বকাল ছিল খুব কম। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ছিল ব্যতিক্রম। ৩০ ঘণ্টার উপরে ঝড়ের প্রভাব থাকায় সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা দীর্ঘ সময় জনমগ্ন ছিল। ভাটার সময়ও এবার পানি কমেনি। ফলে অনেক বন্যপ্রাণী ভেসে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকতে পারে। বনবিভাগের উচিত বাঘ-হরিণের মৃতের সঠিক তথ্য তুলে ধরে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি জলোচ্ছ্বাস ও জলমগ্নতা থেকে বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় নতুন করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন।বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. খালিদ হোসেন জানান, ১০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ৩৫ হাজার বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অসংখ্য গাছপালা উঠে পড়েছে। শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ, মোংলায় বেশ কিছু এলাকার বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয় প্রবেশ করায় অনেক এলাকা জনমগ্ন রয়েছে। ২৮ মে মঙ্গলবার সকালে পানি কমতে থাকায় উপকূলের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষ তাদের বাড়িঘরে ফিরেছে।মৎস্য বিভাগের হিসাব মতে, বাগেরহাটের প্রায় ৩৫ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল। রামপাল, মোংলা, মোড়লগঞ্জ, বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় মৎস্য চাষিদের তুলনামূলক বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে মৎস্য চাষিদের হিসাবে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটের শরণখোলায় গাছ চাপা পড়ে মোসা. ফজিলা বেগম (৫৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ২৭ মে সোমবার দুপুরের আগ মুহুর্তে উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২৮ মে মঙ্গলবার ৫টা ৫৩ মিনিটে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।নিহত মোসা. ফজিলা বেগম খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামের হাফেজ মো. রুহুল আমিনের স্ত্রী। তাদের কোনো সন্তান নেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনে এখানে থাকতেন। মঙ্গলবার সকালে নিজ বাড়িতে এই নারীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, ওই নারী সোমবার মারা গেছেন। কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টি, বিদ্যুৎ ও মুঠোফোন নেটওয়ার্ক না থাকায় মঙ্গলবার বিকেলে আমরা জানতে পেরেছি। তার নাম ঠিকানা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন খান মহিউদ্দিন জানান, সোমবার দুপুরের আগমুহুর্তে ওই নারী রান্না করছিলেন। তখন রান্না ঘরের উপর গাছ পড়ে, ঘটনাস্থলেই ওই নারীর মৃত্যু হয়। তার স্বামীও বেশ অসুস্থ বিষয়টি এলাকাবাসী অনেক পড়ে জানতে পারে। রাতে স্থানীয় লোকজন নিয়ে গাছ সরিয়ে ওই নারীর মৃতদেহ বের করা হয়। মঙ্গলবার সকালে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রচন্ড বৃষ্টি, বাতাস, মোবাইলে চার্জ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় বিষয়টি প্রশাসনকে জানাতে দেরি হয়েছে।শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদিপ্ত কুমার সিংহ বলেন, শরণখোলায় প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টি ছিল। বিদ্যুৎও ছিল না। তাই আমরা বিষয়টি জানতে পারিনি। মঙ্গলবার দুপুরের পর ওই এলাকার চেয়ারম্যান উপজেলায় এসে তার মৃত্যুর বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন। নিহতের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক: রেমালের প্রভাবে খেপুপাড়া ও পটুয়াখালীতে বৃষ্টি হয়েছে ১১১ মিলিমিটার, ঢাকায় সকাল ৬টা পর্যন্ত ৫৯ মিলিমিটার, চট্টগ্রামে ২০৩ মিলিমিটার ও কুতুবদিয়াতে ১২৫ মিলিমিটার। এছাড়া সারা দেশেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যা আজ সারা দিন অব্যাহত থাকবে।উপকূলে ঝড়, বৃষ্টি, জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব চালিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কেন্দ্রভাগ দুপুরের পর ঢাকায় ঢুকবে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ থাকবে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার আর বৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান।২৭ মে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঘূর্ণিঝড় নিয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য দেন।আজিজুর রহমান বলেন, রেমালের কেন্দ্রভাগ দুপুর ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ঢাকার দিকে আসবে। এটি এখন অনেকটা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে ঢাকায় আরও বৃষ্টি হবে। সেই সাথে ঝোড়ো বাতাস বইবে। ঢাকার ওপর দিয়ে এটা পর্যায়ক্রমে সিলেট দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যাবে৷ ঢাকায় আসলে বৃষ্টিপাত আর দমকা বাতাস বাড়বে একটু।
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ, সমুদ্রবন্দরগুলোতে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত
সংশ্লিষ্ট
বাগেরহাট প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব লন্ডভন্ড সুন্দরবনে বন্যপ্রাণির মৃতদেহের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২ জুন রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুন্দরবনের অভ্যন্তরসহ বিভিন্ন নদ-নদী ও চর থেকে ১৩৪টি বন্যপ্রাণির মৃতদেহ উদ্ধার করেছে বনরক্ষীরা।উদ্ধার করা মৃত এসব বন্যপ্রাণির মধ্যে রয়েছে ১৩০টি হরিণ ও ৪টি বন্য শূকর। সুন্দরবনে একটানা ৩৬ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে চলা এই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা যাওয়া এসব বন্যপ্রাণির উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে বনরক্ষীরা।উদ্ধার করা এসব বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ ম্যানগ্রোভ এই বনের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, সুন্দরবনে ৩৬ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে তাণ্ডব চালায় ঘূণিঝড় রেমাল। এসময় ৬ থেকে ৮ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় সুন্দরবন। দীর্ঘসময় ধরে সুন্দরবনর জলমগ্ন থাকায় বন্যপ্রাণির হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।তিনি আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় শেষ হওয়ার পর গত পাঁচদিনে সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, দুবলা, ডিমেরচর, পক্ষীরচর, শেলারচর, নীলকমল, নারিকেলবাড়িয়া ও জ্ঞানপাড়াসহ বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত ১৩০টি হরিণ ও ৪টি বন্যশূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ১৮টি হরিণ ও একটি অজগর সাপ। আহত প্রাণিদের চিকিৎসা দিয়ে বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
রামপাল (বাগেরহাট) প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় রেমালের ছোবলে বিধ্বস্ত গোটা রামপাল উপজেলা। প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ দুর্গত হয়ে পড়েছে। প্রতি মুহূর্তেই এখনো ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় ত্রাণ দপ্তরের ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।উপজেলার ত্রাণ দপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মোতাবেক জানা গেছে, এ উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নে প্রায় পৌনে ২ লক্ষ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষকে দুর্গত বলে চিহ্নিত করেছে উপজেলা প্রশাসন।উপজেলা পিআইও মো. মতিউর রহমান জানান, এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মোট ১ হাজার ৪১০টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ৪৫০টি বাড়ি। এতে শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। রেমালের ক্ষতি কমাতে ১৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এতে প্রায় ১২ হাজার দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলন। প্রশাসনের নজরদারী থাকায় কোনো মানুষ আহত বা নিহত হননি।উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কার্মকর্তা অসীম কুমার ঘোষ জানান, এ উপজেলায় ৮ হাজার মাছের ঘের ও ১ হাজার ৫শ’ পুকুর ভেসে গেছে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। যা আরও বাড়তে পারে।মৎস্য খামারি মো. রেদওয়ান মারুফ জানান, ‘আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার খামারের সব মাছ ভেসে গেছে। কী করে ব্যাংকের লোন শোধ করবো ভোবে পাচ্ছি না।’ একই কথা বলেন সদরের মৎস্যঘের মালিক শেখ মো. আতাহার আলী। তিনি জানান, ‘৫/৬টি ঘেরের সব মাছ ভেসে গেছে। ধারদেনা করে মাছপোনা ফেলেছি। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা এলজিইডি ইঞ্জিনিয়ার গোলজার হোসেন জানান, রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে থাকায় ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে মাঠে কাজ চলছে।উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্মকর্তা জি, এম অলিউল ইসলাম জানান, ঝড়ে মোট ২ হাজার ৯৩ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আম, কলা, পেঁপে, সবজি ও মরিচের ক্ষতি বেশি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকারও উপরে।মাধ্যমিক শিক্ষা কার্মকর্তা আনোয়ারুল কুদ্দুস জানান, মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সকল এলাকার তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্কুল ও মাদরাসা মিলে মোট ১০ প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২২ লক্ষ টাকা। এছাড়াও অফিস কক্ষে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে চেয়ার টেবিলসহ লক্ষাধিক টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে।উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্মকর্তা মো. মতিউর রহমান জানান, মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেতে বিলম্ব হচ্ছে। মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ লক্ষ টাকার বেশি, যা আরও বাড়বে।পোল্ট্রি ও গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাণী সম্পদ হাসপাতালের প্রতিনিধি সুবাস চন্দ্র জানান, বেশকিছু পোল্ট্রি মালিকের মুরগিসহ ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ চলছে বলে জানান তিনি।রামপাল প্রকল্প উপজেলা বাস্তবায়ন কার্মকর্তা মো. মতিউর রহমান জানান, ১০টি ইউনিয়নে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্যে তথ্য ছক শিট প্রেরণ করা হয়েছে। ৩০ মে বৃহস্পতিবার নাগাদ সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। তবে রেমালের প্রভাবে কেউ মৃত্যুবরণ না করলেও মৎস্যঘের, বাড়িঘর, পোল্ট্রি শিল্পের, অবকাঠামো, স্থাপনা ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার পরিমাণ পুরোপুরি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোটি টাকা ধরা হলেও তা হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করছেন ওই কার্মকর্তা।এ বিষয়ে রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা এঁর সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, রেমালের আঘাতে এ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মানুষের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। মৎস্য ঘের ভেসে গেছে, কৃষি, অবকাঠামো, স্থাপনা ও পোল্ট্রি ফার্মের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ৫ টন চাল পেয়েছি। যা আশ্রয় কেন্দ্রের দুর্গতদের দেওয়া হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর বরাদ্দের জন্যে লেখা হচ্ছে। বরাদ্দ পাওয়ার সাথে সাথে তা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে।
মো. কামরুজ্জামান, বাগেরহাট: দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টা সুন্দরবনের উপর তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সুন্দরবন। ২৮ মে মঙ্গলবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৩৯টি হরিণ ও ১টি বন্য শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এছাড়া ১৭টি হরিণকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শুশ্রুষার পর বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।প্রাথমিক অবস্থায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে ৬ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষণ (সিএফ) মিহির কুমার দো এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, সুন্দরবনের কটকা, কচিখালি, দুবলা, বুড়ি গোয়ালিনী, কোকিল মনি, নীলকমল, মান্দারবাড়িয়া ফরেস্ট ক্যাম্পসহ অবকাঠামোগত ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ও সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এটি এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান এ কর্মকর্তা। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নুরুল করিম জানান, দীর্ঘ সময় সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকার জলমগ্ন থাকায় অনেক বন্য প্রাণীর হতহতের ঘটনা ঘটেছে। বন্যপ্রাণীর জন্য খনন করা সুপেয় পানির পুকুরও ভেসে গেছে। বনবিভাগের নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা ওয়ারলেস এখনো সচল হয়নি। তবে বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্টেশনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরা নিরাপদে রয়েছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কাজ চলছে। বন বিভাগের লোকজন সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় কয়েকটি হরিণকে ঝড়ের সময় ভেসে যেতে দেখেছে। দীর্ঘ সময় ঝড়ের প্রভাব থাকায় ভাটার সময়ও জোয়ারের পানি না কমায় সুন্দরবনের বেশিরভাগ এলাকা জলমগ্ন ছিল প্রায় ৩০ ঘণ্টা। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে পরবর্তী ঝড় ঝঞ্জা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে এবং বন্যপ্রাণী প্রাণহানির কমাতে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অসংখ্য উঁচু মাটির কেল্লা নির্মাণসহ বাস্তবমুখী অনেক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।দীর্ঘদিন সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী সেফ দা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বাঘ বা হরিণ জাতীয় বন্যপ্রাণী ৬ ঘণ্টার বেশি পানির মধ্যে প্রতিকূল পরিবেশের টিকে থাকতে পারে না। বিগত সময়ে সুন্দরবনের যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে তার স্থায়িত্বকাল ছিল খুব কম। তবে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ছিল ব্যতিক্রম। ৩০ ঘণ্টার উপরে ঝড়ের প্রভাব থাকায় সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা দীর্ঘ সময় জনমগ্ন ছিল। ভাটার সময়ও এবার পানি কমেনি। ফলে অনেক বন্যপ্রাণী ভেসে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকতে পারে। বনবিভাগের উচিত বাঘ-হরিণের মৃতের সঠিক তথ্য তুলে ধরে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি জলোচ্ছ্বাস ও জলমগ্নতা থেকে বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় নতুন করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন।বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. খালিদ হোসেন জানান, ১০ হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ৩৫ হাজার বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অসংখ্য গাছপালা উঠে পড়েছে। শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ, মোংলায় বেশ কিছু এলাকার বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয় প্রবেশ করায় অনেক এলাকা জনমগ্ন রয়েছে। ২৮ মে মঙ্গলবার সকালে পানি কমতে থাকায় উপকূলের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষ তাদের বাড়িঘরে ফিরেছে।মৎস্য বিভাগের হিসাব মতে, বাগেরহাটের প্রায় ৩৫ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল। রামপাল, মোংলা, মোড়লগঞ্জ, বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় মৎস্য চাষিদের তুলনামূলক বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে মৎস্য চাষিদের হিসাবে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।এদিকে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বাগেরহাটের শরণখোলায় গাছ চাপা পড়ে মোসা. ফজিলা বেগম (৫৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ২৭ মে সোমবার দুপুরের আগ মুহুর্তে উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২৮ মে মঙ্গলবার ৫টা ৫৩ মিনিটে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।নিহত মোসা. ফজিলা বেগম খোন্তাকাটা ইউনিয়নের ধানসাগর গ্রামের হাফেজ মো. রুহুল আমিনের স্ত্রী। তাদের কোনো সন্তান নেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনে এখানে থাকতেন। মঙ্গলবার সকালে নিজ বাড়িতে এই নারীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, ওই নারী সোমবার মারা গেছেন। কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টি, বিদ্যুৎ ও মুঠোফোন নেটওয়ার্ক না থাকায় মঙ্গলবার বিকেলে আমরা জানতে পেরেছি। তার নাম ঠিকানা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন খান মহিউদ্দিন জানান, সোমবার দুপুরের আগমুহুর্তে ওই নারী রান্না করছিলেন। তখন রান্না ঘরের উপর গাছ পড়ে, ঘটনাস্থলেই ওই নারীর মৃত্যু হয়। তার স্বামীও বেশ অসুস্থ বিষয়টি এলাকাবাসী অনেক পড়ে জানতে পারে। রাতে স্থানীয় লোকজন নিয়ে গাছ সরিয়ে ওই নারীর মৃতদেহ বের করা হয়। মঙ্গলবার সকালে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রচন্ড বৃষ্টি, বাতাস, মোবাইলে চার্জ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় বিষয়টি প্রশাসনকে জানাতে দেরি হয়েছে।শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদিপ্ত কুমার সিংহ বলেন, শরণখোলায় প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টি ছিল। বিদ্যুৎও ছিল না। তাই আমরা বিষয়টি জানতে পারিনি। মঙ্গলবার দুপুরের পর ওই এলাকার চেয়ারম্যান উপজেলায় এসে তার মৃত্যুর বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন। নিহতের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক: রেমালের প্রভাবে খেপুপাড়া ও পটুয়াখালীতে বৃষ্টি হয়েছে ১১১ মিলিমিটার, ঢাকায় সকাল ৬টা পর্যন্ত ৫৯ মিলিমিটার, চট্টগ্রামে ২০৩ মিলিমিটার ও কুতুবদিয়াতে ১২৫ মিলিমিটার। এছাড়া সারা দেশেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যা আজ সারা দিন অব্যাহত থাকবে।উপকূলে ঝড়, বৃষ্টি, জোয়ার আর জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব চালিয়ে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কেন্দ্রভাগ দুপুরের পর ঢাকায় ঢুকবে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ থাকবে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার আর বৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান।২৭ মে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঘূর্ণিঝড় নিয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব তথ্য দেন।আজিজুর রহমান বলেন, রেমালের কেন্দ্রভাগ দুপুর ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ঢাকার দিকে আসবে। এটি এখন অনেকটা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে ঢাকায় আরও বৃষ্টি হবে। সেই সাথে ঝোড়ো বাতাস বইবে। ঢাকার ওপর দিয়ে এটা পর্যায়ক্রমে সিলেট দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যাবে৷ ঢাকায় আসলে বৃষ্টিপাত আর দমকা বাতাস বাড়বে একটু।
মন্তব্য করুন