অনন্তকালের প্রতিধ্বনি: একুশে ফেব্রুয়ারি
নাসরীন মুস্তাফা: অনেকগুলো যদি মাথায় নিয়ে এভাবে যদি ভাবতে বসি... যদি ২১০০ সাল পর্যন্ত পৃথিবী টিকে থাকে, যদি তখনও পৃথিবীতে মানুষ থাকে, যদি তখনও মানুষ কথা বলতে ভুলে না যায় বা বাদ না দেয় কথা বলা, যদি তখনও কথা বলার মাধ্যম থাকে মানুষের ভাষা, যদি তখনও মানুষ মাত্র একটি ভাষায় কথা না বলে, যদি তখনও মানুষ যার যার ভাষায় কথা বলে, তাহলে... তাহলে কী? তাহলে ২১০০ সালেও পৃথিবীতে মানুষ নিজের ভাষার আত্মমর্যাদা রক্ষার দিন হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি উদযাপন করবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঐ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মার্তভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার পর সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে প্রতিটি ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার মহতী আন্দোলন হিসেবে। এমনকি যে পাকিস্তান বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার দাবিতে প্রতিবাদ করার ‘অপরাধে’ বাংলাভাষী তরুণের বুকে গুলি ছুঁড়েছিল, সেই পাকিস্তানেও দিবসটি উদ্যাপিত হয়। একথা অনস্বীকার্য যে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে এই বাংলার মাটিতে যে বীজ রোপিত হয়েছিল, তা ক্রমশঃ মহীরুহ হতে হতে বাঙালির নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে এবং তা আরও বিস্তৃত হতে হতে বিশ্বময় মানুষের সভ্যতা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির মতো অনেক কিছুই ভারত নিজস্ব পণ্য হিসেবে দাবি করে। ভারতেও আছে বাংলাভাষী মানুষ। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিজের বলে দাবি করার অধিকার একমাত্র বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ নামের ভূখ-ের বাংলাভাষী মানুষ ছাড়া আর কারোর নেই। এভাবেও ভাবা যায় Ñ একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি কেবলমাত্র বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষরা সৃষ্টি করেছে এবং এটিই একমাত্র বৈশ্বিক একটি ইস্যু, যার জন্ম দিয়েছি কেবল আমরাই। কয়েক দিন আগে সংগীতশিল্পী কবীর সুমনের একটি রাগী স্ট্যাটাস দেখছিলাম। প্রসঙ্গ যা-ই থাক্, প্রসঙ্গে বলা বাংলা ভাষার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক না পড়ে পারিনি। তিনি লিখেছিলেন, ‘ভাগ্যিস বাংলাদেশ হয়েছিল, ভাগ্যিস বাহান্নয় ঘটেছিল একুশ, ভাগ্যিস একদিন শুনেছিলাম বাংলার বজ্রকন্ঠ: ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ ভাগ্যিস আমার মাভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা!’ মাভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষা বাংলা না হয়ে যে ভাষা-ই হোক্ না কেনো, বলতেই হবে-ভাগ্যিস বাহান্নয় ঘটেছিল একুশ! ২১০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনের অনুষ্ঠান কল্পনায় এনে কান পেতে শুনুন বিশ্ব বলবে- ভাগ্যিস বাহান্নয় ঘটেছিল একুশ! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১০০ পালনের সময় ভবিষ্যতের মানুষ যখন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখের কথা স্মরণ করবে, তখন ঢাকা শহর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষা শহিদদের কথা বলবে। আজ থেকে ৭৬ বছর পর ঢাকা শহর কেমন হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? পরিবর্তন ঘটবে নিশ্চয়ই। ভাষা শহিদরা কেবল রয়ে যাবেন একই রকম। ২৫ বছরের আবুল বরকত, ২৭ বছরের আবদুস সালাম, ৩৩ বছরের আব্দুল জব্বারের বয়স বাড়বে না। ঐ সময় আরও যারা শহিদ হয়েছিলেন, সেই কিশোর-তরুণদের বয়স আটকে থাকবে একই সময়ে। হয়তো প্রযুক্তির সাহায্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও হলোগ্রাফিক ইমেজে ত্রিমাত্রিক অবয়ব নিয়ে সেই কিশোর-তরুণরা ২১০০ সালের মানুষদের সামনে এসে দাঁড়াবেন, বলবেন কেনো তাঁরা নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। বলবেন, মা’কে মা বলে ডাকার অধিকার চেয়েছিলেন কেবল. আর তাতেই মৃত্যুকে বরণ করতে হয়েছিল তাদের। ভবিষ্যতের মানুষরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও হলো- গ্রাফিক ইমেজে ত্রিমাত্রিক অবয়বে দেখবেন হয়তো ১৯৯৯ সালের বাঙালি বীরদের যারা দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে নেমেছিলেন। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিসংঘে উত্থাপন করেছিলেন সেই দাবি। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের হাত দিয়ে আসে স্বীকৃতি। ভবিষ্যতের সেই সময়েও ঢাকা শহর কি বায়ুদূষণে শীর্ষস্থান দখলকারী জায়গা থাকবে? শহরের সবখানে সাইনবোর্ড-ব্যানার ঝুলবে, যেখানে বাংলা অক্ষর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর? শহরবাসী তখনও কি মনে করবে বাংলা ভাষাটা ‘ঠিক আসে না’ বলা দারুণ আধুনিকতা? বাংলা ভাষার ধারক-বাহক বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ততোদিনে কি টিকে থাকবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকাতেই থাকবে, কিন্তু বাংলাসহ বাংলাদেশের অধিবাসীদের মায়ের ভাষা নিয়ে গভীরতর গবেষণা কি হবে, যা গুরুত্বের সাথে আলোচিত হবে বিশ্বে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে তখনো কি অনুভব করতে পারবে? তখনো কি এই তরুণদের জীবনের সর্বোত্তম অর্জন হবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশকে পরিত্যাগ করে অন্য ভাষা ও অন্য দেশের নাগরিকত্ব বরণ করা? ২১০০ সালে বিশ্ব আরও বিকশিত হবে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা হবে তীব্রতর। হয়তো জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে এখন যেমন দ্বন্দ্ব চলতে চলতে যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে, তখন তার আকার ও ধরণ হবে আরও বিস্তৃত, আরও জটিল। একমাত্র ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পৃথিবীর সকল ভাষার, সকল জাতি, সকল সম্প্রদায়, সকল রাষ্ট্রের মানুষের ঐক্যবদ্ধ পরিচয়কে আলিঙ্গণ করতে উদ্দীপনা জোগাবে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে সবাই প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে রূপান্তর ঘটে যাওয়া মানুষের সভ্যতার ভাষাগত বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐক্য এবং মানবতার স্থায়ী চেতনার অনতিক্রম্য প্রতিফলন দেখাতে সচেষ্ট হবে। গৌরবময় অতীতের প্রতিধ্বনি নিয়ে শুরু হবে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ এর যাত্রা, এই কল্পনা যদি কেউ করতে পারেন, তবে বুঝবেন সেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ হিসেবে আমাদের বাংলা ভাষা নিয়ে সচেতন থাকা কত জরুরি। উৎসবগুলো কোনো একক ভৌগোলিক অবস্থানে সীমাবদ্ধ থাকবে না অবশ্যই। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, হলোগ্রাফিক প্রযুক্তি এবং ততদিনে উদ্ভাবিত আরও নতুন প্রযুক্তির (যা এখন কল্পনায় আনা সম্ভব নয়) সাহায্যে বিশ্বের মানুষদের সকল মহাদেশ জুড়ে সংযোগ করে দেয়, মানুষের শারীরিক সীমানাকে অতিক্রম করে একটি বিশ্বব্যাপী উদ্যাপন তৈরি করে, যেখানে মানুষ মানুষের সাথে হাত মেলায়। বিশ্ব ঐতিহ্যের ভিত্তি হিসেবে ভাষাগত বৈচিত্র্যের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে মানুষ তখন যার যার ভাষায় কথা বলবে, অন্যের ভাষাকে স্পষ্ট বুঝে নেবে নিজের ভাষায়। প্রতিটি ভাষা একটি অনন্য গল্প বহন করে এবং প্রতিটি গল্প মানব ইতিহাসের সমৃদ্ধ বর্ণনায় অবদান রাখে, তখনো রাখবে নিশ্চয়ই। তবে বিশ্ব যখন ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির দিকে ফিরে তাকালো, তখন অনুভব করল সব গল্প ছাপিয়ে অনন্তকালের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষার সন্তান মা’কে মা ডাকতে চেয়ে যে অনন্য অসাধারণ গল্পের জন্ম দিয়েছিল, সেই গল্পটি। ভাষা আন্দোলনের জন্মস্থান ঢাকায় সেদিন কী কী হতে পারে? কী কী হবে রাজধানী ঢাকা যার, সেই দেশ বাংলাদেশে? বর্ণাঢ্য স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজন নিশ্চয়ই থাকবে বলে আশা রাখি। আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগকে উৎসাহিত করে বিশ্বব্যাপী ভাষা বিনিময়ে অংশ নেবে, প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষকে ভাষাগত বাধাগুলো ভেঙে মানবতার বোধকে উন্নত করে ভাষার সৌন্দর্যকে আরো স্পষ্টভাবে অনুভব করতে দেবে। ভবিষ্যতের প্রজন্ম বিশ্বের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নিজের ভাষার ভূমিকাকে স্বীকার করবে হয়তো। ২১০০ সালের আগে ২০৩০ সালকে মানুষের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বাঁক পরিবর্তনকারী সময় বলে ধরে নেওয়া যায়। টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিটি দেশকে ১৭টি আন্তঃসংযুক্ত বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে প্রতিটি দেশকে। জলবায়ু পরিবর্তন, অস্ত্রের অকারণ প্রতিযোগিতা, যুদ্ধবাজ ভূরাজনীতির কারণে পুরোপুরি পেরে না উঠলেও মোটা দাগে বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে এক সাথে নিয়ে এবং অবশ্যই কাউকে পেছনে না রেখে এগিয়ে যাওয়ার মানবিক উদ্দেশ্য সাধন হবে। এই সাফল্য যাতে মানুষ হাতছাড়া না করে তার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক যে কোনো আয়োজনে জোরালো কণ্ঠে সুনির্দিষ্টভাবে বক্তব্য রাখছেন, কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাব করছেন, সচেতন করছেন। আশাবাদী হতে চাই। এভাবে বৈশ্বিক একতার বীজ বপন করার পর বিশ্ব প্রযুক্তিগত এবং সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই একটি রূপান্তরমূলক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে, যার চমৎকার ফলাফল দেখা যেতে পারে ২১০০ সালে নতুন শতাব্দীতে প্রবেশের পর। পৃথিবী হয়ে উঠবে বিভিন্ন সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল, একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব সমাজ হিসেবে সমৃদ্ধ। এর চমৎকার উদযাপন ঘটবে স্বাভাবিকভাবেই ২১ ফেব্রুয়ারিতে, কেননা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানুষকে স্বাতন্ত্র্যবোধ বজায় রেখে, সবাইকে এক সাথে নিয়ে, কাউকে পেছনে না রেখে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়, তখনো শেখাবে। আজকের বাংলাদেশে যখন দেখি নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে ভালো না বাসার প্রাণঘাতী উন্মাদনায় ঘুরপাক খাচ্ছেন কেউ কেউ, তখনো ভয় পাই না এমন করে ভাবতে। কেননা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এই ভূখ-ের মানুষ নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতির শেকড় থেকে পুষ্টি নিয়ে টিকে থাকার শক্তি জোগায়, ইতিহাসে এত এত উদাহরণ থাকার পর ভয় পাই না। টেকসই উন্নয়নের পৃথিবীতে বাংলাদেশের মানুষ টিকে থাকার প্রয়োজনেই ফিরবে মায়ের ভাষা আর মায়ের আঁচলের মতো মমতামাখা সংস্কৃতির কাছে। ফিরিয়ে আনার শক্তি জোগাতে অনন্তকালের প্রতিধ্বনি হৃৎকম্পনের মতো আন্দোলিত হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি নামক দিনটিতে। কাজেই, ভয় নেই। লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও নাট্যকার